শনিবার
২রা আগস্ট, ২০২৫
১৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২

আমরা জনতার পক্ষে সত্য বলি

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ ভারতের পিছুটানে বিকল্পের খোঁজে বাংলাদেশ

Fresh News রিপোর্ট
জুলাই ৭, ২০২৫
২:৩৮ অপরাহ্ণ

দীর্ঘদিন ধরে থমকে থাকা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অবশেষে ফিরেছে প্রাণের স্পন্দন। নীরবতা ভেঙে প্রকল্প এলাকায় এখন জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতিমূলক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে এরইমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকারও বেশি।

তবে এই আশাবাদের ভেতরেও জমে আছে অনিশ্চয়তার ঘন মেঘ। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির মূল অর্থায়নকারী ভারত গত পাঁচ বছরে একটি টাকাও ছাড় করেনি। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দুশ্চিন্তা। এই জটিলতা কাটিয়ে প্রকল্পকে গতিশীল করতে সরকার এখন বিকল্প অর্থায়নের খোঁজে তৎপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চীন, জাপান এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে।

২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয় ‘বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প’। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে প্রকল্পের পরিধি ও ব্যয় দুটোই বেড়ে এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটিতে। অথচ প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের ৩০ জুন। অর্থাৎ হাতে রয়েছে মাত্র এক বছর। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র, নির্মাণ ও সমাপ্তি সবকিছু শেষ করা এখন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

রানীরহাট হয়ে সিরাজগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেললাইন চালু হলে বগুড়া ও আশপাশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা থেকে ঢাকায় যাতায়াতের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। পূর্বের তুলনায় দূরত্ব কমবে প্রায় ১১২ কিলোমিটার। এতে একদিকে যেমন সাশ্রয় হবে সময়, অন্যদিকে দ্রুত পণ্য ও যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত হবে যা অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

আমরা এখন আর অপেক্ষায় বসে নেই, বিকল্প পথে এগিয়ে যাচ্ছি। সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে, তাই সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলে প্রকল্পটি আবার থেমে যেতে পারে।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে ঢাকায় সরাসরি সংযোগ তৈরি করতে প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে শুধু বগুড়াতেই জমির পরিমাণ ৪৭৯ একর।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৪ সালের জুন মাসে। সংশ্লিষ্ট মালিকদের জমির ক্ষতিপূরণ দিতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ‘ভূমি অধিগ্রহণ’ খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, বগুড়া অংশে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য এক হাজার ৩০০ একর জমি শনাক্ত করা হয়েছিল। তবে যাচাই-বাছাই শেষে এখন ৪৭৯ একর জমিই অধিগ্রহণের আওতায় আসছে।

বিকল্প খুঁজছে বাংলাদেশ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গতি পেলেও আবারো অনিশ্চয়তায় ঢাকা পড়েছে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। ২০১৮ সালে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৪৪০০ কোটি রুপির লাইন অব ক্রেডিট (খঙঈ) সহায়তায় এই প্রকল্পে অর্থায়নের সমঝোতা হয়। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ঊজউ) নানা প্রস্তুতি নিলেও গত পাঁচ বছরে ভারতীয় অর্থ ছাড়ের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সূত্র বলছে, লাইন অব ক্রেডিট কার্যকর করতে একাধিক দফা যোগাযোগ হলেও ভারতীয় পক্ষ থেকে গড়িমসি চলে আসছে। প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল- এ শর্তেই সমস্যা তৈরি হয়। বাংলাদেশ খঙঈ বাতিলের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানালেও ভারত এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি। ফলে প্রকল্পের অর্থায়নে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার এখন বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিকল্প অর্থদাতা হিসেবে আলোচনা চলছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (অওওই), জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (ঔওঈঅ), চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ঈউই), এমনকি ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (ওউই) সঙ্গেও।

এই রেললাইন চালু হলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসবে, সময় বাঁচবে, পণ্য দ্রুত যাবে। এখন অনেক সময় সকালে ট্রেন ছাড়লেও ঢাকায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। একবার যদি এই সংযোগ স্থাপন হয়, তাহলে আমরা নতুন করে শ্বাস নিতে পারবো।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রাথমিক আলোচনা এরইমধ্যে শুরু হয়েছে এবং অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাইকা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শুরু করেছে।

এদিকে অনিশ্চয়তা কাটাতে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ঊজউ যৌথভাবে প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (রিভাইজড ডিপিপি) তৈরি করছে। ব্যয়, সময়সীমা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে এই প্রস্তাব শিগগির পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

রেলওয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন আর অপেক্ষায় বসে নেই, বিকল্প পথে এগিয়ে যাচ্ছি। সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে, তাই সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলে প্রকল্পটি আবার থেমে যেতে পারে।

এরই মধ্যে প্রকল্পের অন্যতম ধাপ হিসেবে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে মোট ৯৬০ একর জমি পেতে এরই মধ্যে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় ৪৭৯ একর এবং সিরাজগঞ্জে ৪৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২০১৭ সালের হুকুমদখল আইনের ৭ ও ৮ ধারা অনুযায়ী নোটিশও জারি হয়েছে।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ করা যেতে পারে। তবে অর্থায়নের বর্তমান বাস্তবতা বলছে, সময়মতো সহায়তা না এলে রেলপথ বাস্তবায়ন আবারো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
নতুন এই ডুয়েলগেজ রেললাইন চালু হলে বগুড়া ও আশপাশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ আরও সরাসরি ও গতিশীল হবে। বর্তমানে বগুড়া থেকে ঢাকায় যেতে রাজশাহী বা ঈশ্বরদী হয়ে বড় একটি পথ ঘুরতে দিতে হয়। কিন্তু রেলপথটি বাস্তবায়িত হলে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে রাজধানীতে পৌঁছাতে সময় কমে আসবে প্রায় ৫-৭ ঘণ্টা থেকে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায়। দূরত্বও কমে আসবে প্রায় ১১২ কিলোমিটার। এই রেলপথ শুধু যোগাযোগ নয় বরং পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি, কৃষিপণ্য বিপণন, শিল্পকারখানা, পর্যটন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে, পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বাঁচবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন রেলপথ চালু হলে উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় শিল্প সম্ভাবনা ৩০-৪০ শতাংশ বাড়বে, আর মোট অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা ১২-১৫ শতাংশ থেকে ৪-৫ পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়বে।

অর্থ বরাদ্দ মেলায় এখন অধিগ্রহণ করা জমির দাম পরিশোধ শুরু করা হবে। তবে প্রকৃত কাজের অগ্রগতি নির্ভর করছে মূল প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার ওপর। এ রেলপথ নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের অন্তত আট জেলা উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের চেহারাই পাল্টে যাবে।
এ নিয়ে কথা হয় বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই রেললাইন চালু হলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসবে, সময় বাঁচবে, পণ্য দ্রুত যাবে। এখন অনেক সময় সকালে ট্রেন ছাড়লেও ঢাকায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। একবার যদি এই সংযোগ স্থাপন হয়, তাহলে আমরা নতুন করে শ্বাস নিতে পারবো।

প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, অর্থ বরাদ্দ মেলায় এখন অধিগ্রহণ করা জমির দাম পরিশোধ শুরু করা হবে। তবে প্রকৃত কাজের অগ্রগতি নির্ভর করছে মূল প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার ওপর। এ রেলপথ নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের অন্তত আট জেলা উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের চেহারাই পাল্টে যাবে।

প্রকল্পের আওতায় মোট ৯টি নতুন রেলস্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় ৪টি এবং সিরাজগঞ্জে ৫টি। বগুড়ার রানীরহাট ও সিরাজগঞ্জে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন গড়ে তোলা হবে। এতে করে ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চলের রেলযোগাযোগ আরও বহুমুখী ও টেকসই হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।