শনিবার
২রা আগস্ট, ২০২৫
১৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২

আমরা জনতার পক্ষে সত্য বলি

আইসিডিডিআর বি’র গবেষণায় বস্তিবাসীর জন্য গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর প্রস্তাব

Fresh News রিপোর্ট
জুলাই ৭, ২০২৫
২:৩০ অপরাহ্ণ

নগরীর নিম্নবিত্ত প্রসূতি ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে করা নিউট্রি-ক্যাপ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। সোমবার (৭ জুলাই) আইসিডিডিআর, বি’র মহাখালীর সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে গবেষণাটির ফলাফল তুলে ধরা হয়।

অ্যাডভান্সিং সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (অ্যাডসার্চ) প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়াবাদ বস্তিতে বসবাস করা মানুষের ওপর করা হয়।

গবেষণায় প্রাথমিকভাবে উঠে এসেছে স্থানীয় জনগণের নেতৃত্বে পরিচালিত এবং একীভূত পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি কর্মসূচি প্রসূতি, কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও দ্রুত নগরায়নের ফলে ক্রমশ নতুন নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে দেশে নগরায়নের মাত্রা ৮ শতাংশ হলেও ২০২২ সালে তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ শহরে বাস করছে, এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে নগরের স্বাস্থ্য সূচক গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ভালো হলেও শহরে বাস করা মানুষদের মধ্যে আয়ের তারতম্য ব্যাপক এবং এ ক্ষেত্রে বিপুল বৈষম্য বিদ্যমান। বস্তিতে বাস করা অর্ধেকের বেশি পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের ও শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ খর্বাকৃতির।

যেখানে শহরের ৫৩ শতাংশ নারী প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে গর্ভকালীন চার বা ততোধিকবার সেবা পান, সেখানে বস্তিতে এ হার মাত্র ৪০ শতাংশ। এছাড়া বস্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী ১৫ বছরের নিচে। ফলে বস্তিতে বাস করা গর্ভবতী মহিলা-কিশোরী এবং শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

বাউনিয়াবাদ: নাগরিক দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি

বাউনিয়াবাদ যেন নগরে বাস করা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের বাস্তব সংকটগুলোরই এক জীবন্ত চিত্র। এই এলাকায় বাস করা ১৫,০০০ বিবাহিত নারীর মধ্যে গবেষণার সময়কালে ৭২১ জন গর্ভবতী নারী শনাক্ত হন। এই গবেষণা কর্মসূচিতে আরও ৪,২০০ কিশোরী এবং দুই বছরের নিচের ২,৫০০ শিশু অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৬,৫৩২টি পরিবারের মধ্যে ২,৮২৬টি নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গভীর বিশ্লেষণ চালানো হয়।

এসব পরিবারে যদিও কিছু সূচকে স্থিতিশীলতা দেখা গেছে, দারিদ্র্য ও অসুবিধা ছিল প্রকট। প্রতিটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২১,০০০ টাকা, তবু প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার খাদ্য সংকটে ভুগেছে; খাদ্য সংকটে ভোগা পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত ছিল। সেই সঙ্গে ৯১ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত ছিল। ৩৯ শতাংশ পরিবারের একটি ছোট্ট ঘরে তিনজনের বেশি সদস্য ঘুমাতেন। ৪২ শতাংশ পরিবারের নারীরা সংসারের আয়ে অবদান রাখতেন। এবং এক-তৃতীয়াংশ পরিবার প্রধান প্রাথমিক শিক্ষাও সম্পন্ন করতে পারেননি।

নিউট্রি-ক্যাপ-এর ইতিবাচক ফলাফল

নিউট্রি-ক্যাপ কর্মসূচি তিনটি নগরের বস্তিতে বাস করা তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী—গর্ভবতী নারী, কিশোরী ও দুই বছরের নিচের শিশুদের লক্ষ্য করে একীভূত সেবা প্যাকেজ চালু করে। গর্ভবতীরা প্রতি মাসে বাড়িতে গিয়ে পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর মতো পুষ্টি উপাদান এবং ওজন, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন ও রক্তে শর্করার পর্যবেক্ষণ পায়। তাদের নিয়মিত প্রসবপূর্ব চেকআপ ও যথাযথ বিশ্রামে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। কর্মসূচিভুক্ত নারীদের গড় ওজন বৃদ্ধি ছিল ৮.৯ কেজি, যেখানে তুলনামূলক গ্রুপে তা ছিল ৭.৫ কেজি।

নিরাপদ প্রসব, হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি পায়; কমে যায় গর্ভপাত, মৃতভ্রুণ ও নবজাতকের মৃত্যুহার। নির্ধারিত সময়ের আগেই গর্ভকালীন বয়সের তুলনায় কম ওজনের সন্তান জন্মের ঝুঁকি কমে ১৬ শতাংশ।

কিশোরীদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ গড়ে ১২.০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৮ গ্রাম/ডেসিলিটার। খাদ্য বৈচিত্র্য স্থির থাকলেও স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এই কিশোরীদের মধ্যে ১৪.৯ শতাংশ ছিল অপুষ্টির কারণে ক্ষীণকায় আর ১২.৬ শতাংশ ছিল অতিরিক্ত ওজনের—যা দেশের শহরাঞ্চলের গড় পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রয়েছে।

শিশুদের স্বাস্থ্যেও দেখা যায় সুস্পষ্ট অগ্রগতি। উচ্চতা ও ওজন উভয়ই উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া হজম প্রক্রিয়া ও অস্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে বলে পাওয়া গেছে। জৈবিক পরীক্ষায় দেখা যায়, অস্ত্রের প্রদাহ কমে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সফলতাএই কর্মসূচির ফলে চিকিৎসায় পারিবারিক খরচ কমে এসেছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কমেছে।

যদিও সেবার পেছনে সময় বেশি দিতে হয়েছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যয় কম ছিল। মানবসম্পদের খরচ ছিল সবচেয়ে বেশি, তবে গবেষণা বলছে—এই মডেল ব্যবস্থায়িত হলে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

প্রয়োগযোগ্য মডেল

গবেষক দলের প্রধান ড. মোস্তফা মাহফুজ বলেন, এই মডেলের সফলতার পেছনে রয়েছে স্থানীয় জনগণের অবদান। এই মডেল কাজ করেছে কারণ এটি স্থানীয় জনগণের কথা শুনেছে, স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং একাধিক বাধাকে একসঙ্গে মোকাবিলা করেছে। একদিকে মানুষের সহমর্মিতা অন্যদিকে তথ্য প্রমাণ ভিত্তিক কর্মসূচি -এই দুয়ে মিল হলে সম্ভাবনা অসীম বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আইসিডিডিআর, বি-র নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, বস্তিবাসীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। নিউট্রি-ক্যাপ-এর মতো অভিযোজিত মডেলগুলো শুধু কার্যকরই নয়, বরং দেশের অন্য বস্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও প্রসারণযোগ্য।