রবিবার
৩রা আগস্ট, ২০২৫
১৯শে শ্রাবণ, ১৪৩২

আমরা জনতার পক্ষে সত্য বলি

বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা :ফখরুল

Fresh News রিপোর্ট
জুলাই ৬, ২০২৫
৪:০৬ অপরাহ্ণ

বিএনপি সংস্কারবিরোধী—এটা একটি মহলের পরিকল্পিত অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু একটি মহল, একটি চক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

আজ রোববার বেলা ১১টায় রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে মিডিয়ার কিছু অংশ এবং কিছু ব্যক্তিত্ব বিএনপির সংস্কার সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা বলছে—যেগুলো সঠিক নয়। বিএনপির কমিটমেন্ট টু রিফর্মস, এটা নিয়ে কোশ্চেন করার কোনো সুযোগ নেই।’

বিএনপি কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে বা অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে নয়; নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য বিএনপি ১৫ বছর লড়াই–সংগ্রাম করেছে। এর প্রাথমিক বিষয় ভোটের অধিকার, বাক্স্বাধীনতা, ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি কোনো ষড়যন্ত্র দেখছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সে কথা আমি এই মুহূর্তে বলব না। তবে নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায়, তারা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি নয়, তারা নিশ্চয়ই জুলাই–আগস্ট বিপ্লবের পক্ষের শক্তি নয়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহ ও প্রত্যাশা যেমন অনেক, তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছে বিএনপি। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যেসব প্রস্তাব পেশ করেছে, তার বিপরীত কিংবা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে সংস্কার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।

বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে আন্তরিক—এটা বলতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ২০১৬ সালে বিএনপি ঘোষিত ভিশন ২০৩০, ২০২০ ও ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং তারপরে অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কারের কর্মসূচির কথা জানান। একই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সংস্কারপ্রক্রিয়ায়ও বিএনপি সহযোগিতা করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় কিছু কিছু প্রস্তাবে দ্বিমত বা ভিন্নমতও দিয়েছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্রকাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোনো প্রস্তাবের যুক্তিসংগত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলেই আমরা মনে করি।’ তাঁর মতে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এমন কোনো প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এমন সমর্থন থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা নয়, বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।

এ সময় বিএনপির মহাসচিব ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তাঁর দলের আলোচনা এবং এ পর্যন্ত কতগুলো প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে, তার একটা বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতে বিএনপি সম্মত হয়েছে। কেবল ২৯ নম্বর সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছে বিএনপি। এটা না হলে দুদকের কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত, ৫টিতে আংশিক একমত ও ৫টিতে ভিন্ন মত দিয়েছে বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘১১টি প্রস্তাবে আমরা একমত হতে পারিনি। যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি প্রশাসনিক অসংগতির বিষয় উল্লেখযোগ্য যে পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।’

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে একমত ও ৯টিতে আংশিক একমত হওয়ার কথা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘১৮টি প্রস্তাবে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছি। উল্লেখযোগ্য যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবিষয়ক সব প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা ইতিমধ্যে কোনো অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রেটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন হবে।’

নির্বাচনী ব্যবস্থাবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশে মধ্যে ১৪১টিতে একমত, ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত এবং ৬৪টিতে ভিন্নমতসহ একমত হয়েছেন বলে জানান বিএনপির মহাসচিব। ভিন্নমতসহ একমত হওয়ার ব্যাখ্যায় বলেছেন, এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে, সেটা প্রস্তাব করা হয়েছে। ২৪টি বিষয়ে বিএনপি একমত হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাসংক্রান্ত ১২টি আইন ও ৬টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে।

সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফাওয়ারি মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ—দুই বিষয়ে আমরা ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি।’

প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও বিএনপি তাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে জানিয়ে দলের মহাসচিব বলেন, ‘জাতীয় সংসদে সংসদ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটিসহ আসনসংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।’

এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানাবিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও বিএনপি একমত হয়েছে বলে জানান দলের মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয়ে এখনো আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে আমাদের দলের প্রতিনিধিবৃন্দের কাছে আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে র‍্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি, দল কিংবা কমিশনের আছে কি না—তা বিবেচনায় নিতে হবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি।’