তিনি ছিলেন অনন্য। তিনিই ছিলেন সেই পার্থক্য গড়ে দেওয়া মানুষ। বরাবরই তিনি ছিলেন আলাদা। ফুটবল ইতিহাসের এক রূপকথার রাতে, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে লিওনেল মেসিকে নিয়ে এমনই আবেগঘন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন ব্রিটিশ ধারাভাষ্যকার পিটার ড্রুরি। সেই ম্যাচকে আজও মনে করা হয় ফুটবল বিশ্বকাপের সবচেয়ে নাটকীয় ও হৃদয়ছোঁয়া ফাইনাল। পুরস্কার নিতে এগিয়ে যাওয়া মেসিকে বর্ণনা করতে গিয়ে ড্রুরির কণ্ঠে উঠে এসেছিল সত্যিকার আবেগের সুর।
মাত্র ছয় বছর বয়সে দাদির হাত ধরে মাঠে পা রাখা এক ছোট্ট ছেলের মধ্যে তখনই যে বিশেষ কিছু ছিল, তা বোঝা গিয়েছিল। বল পায়ে সহজাত দক্ষতায় বড়দের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া সেই শিশুই হয়ে উঠেছিল পার্থক্য গড়ে দেওয়া এক কিংবদন্তি।
এই যে মেসির চলা, তা থেমে থাকেনি। এখনও তিনি নিজের জাদু ছড়ান মাঠে। চলতি সপ্তাহেই মেসির ক্লাব ইন্টার মায়ামি ইতিহাস গড়েছে, ইউরোপীয় ক্লাবকে হারিয়ে দিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে। এমন কিছুর নেতৃত্বে যে ছিলেন লিওনেল মেসি, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
১৯৮৭ সালের ২৪ মে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম মেসির। শৈশবেই ধরা পড়ে হরমোন জনিত জটিলতা। কিন্তু প্রতিভা আর অধ্যবসায়ের মিশেলে সেই বাধা জয় করেন তিনি। রোজারিও থেকে বার্সেলোনা, বার্সায় ন্যাপকিনে চুক্তি, তারপর একের পর এক অবিস্মরণীয় রাত – সবই যেন এক জীবন্ত উপাখ্যান।
সমালোচকরা বলতেন, মেসি হেডে গোল করতে পারেন না – ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে করা গোলটিই তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। আবার বলা হতো, ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে তিনি নিষ্প্রভ। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ইংলিশ টপ সিক্স ক্লাবগুলোর বিপক্ষে তিনিই সর্বাধিক গোলদাতাদের একজন।
সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, তিনি বার্সেলোনার হলেও আর্জেন্টিনার নন। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে দিতে সময় নেননি মেসি। ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা জয়, এরপর ফিনালিসিমা এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ – সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনার হয়েও নিজেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল করে তুলেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে হারের পর মেক্সিকোর বিপক্ষে ২৫ গজ দূর থেকে নেয়া এক শটে আবারও তিনি প্রমাণ করেন – পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মানুষ বলতে কাকে বোঝায়। ফাইনালের রাতটায় লুসাইল স্টেডিয়ামে সেই জাদুরই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটায় মেসি, হয়ে ওঠেন ইতিহাসের সেরা।
মেসির গল্প মুগ্ধ করে কারণ সেটি কেবল ফুটবল মাঠের নয়, জীবনের গল্পও। কারণ আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে চেয়ে থাকি একজন ‘পয়েন্ট অব ডিফ্রেন্স’ হতে। সেই প্রেরণাটাই দিয়ে যান মেসি – যিনি নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে জয়ী হতে হয়।
আজ মেসির বয়স ৩৮। জীবনের প্রায় সব অর্জন তার হাতে, তবু খেলছেন। হয়ত চোখে রয়েছে ২০২৬ বিশ্বকাপের স্বপ্ন। নিজের গল্পকে শেষ করতে চান সেখানেই, যেখানে তিনি অমর হয়েছেন। রোজারিওর সেই ছেলেটির সঙ্গে আমাদের অনুভবগুলোও হয়ত এক হয়ে যাবে, শেষবারের মতো।