বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া, দেশে কর্মস্থলের কারণে বা অন্যান্য কারণে অনেক ভোটারও ভোটাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় এখনও কার্যকরী পোস্টাল ব্যালট বা ডাকযোগে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়ায়, এসব নাগরিকদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে না।
বর্তমানে প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও কারাবন্দির জন্য পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এর বাস্তবায়ন প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভোটারের নাম, ঠিকানা এবং ভোটার তালিকার নম্বর উল্লেখ করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে আবেদন করতে পারবেন। এর পর, রিটার্নিং অফিসার পোস্টাল ব্যালট পাঠাবেন। তবে এই প্রক্রিয়া এতটাই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ যে প্রবাসীরা এতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হন না।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তারা ভোটারদের পোস্টাল ব্যালট সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেন এবং ডাক বিভাগকে তা অগ্রিম ডাকমাশুল ছাড়াই পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে, বাস্তবে সিলেবাসটি খুবই সীমিত ছিল, কারণ বেশিরভাগ প্রবাসী ভোটার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাড়া দেননি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসী ভোটারদের সাড়া পাওয়া যায়নি, বিশেষ করে যে পরিমাণ ভোটারের প্রয়োজন ছিল, তা তুলনামূলকভাবে খুবই কম ছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও, আইনি প্রক্রিয়ায় পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার আবেদন পেয়ে মাত্র ১,৯৬১ ভোটারের কাছ থেকে ভোট গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল। অনেক ভোটারের আবেদনও ছিল অব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া ঠিকঠাক না হওয়া কারণে বাতিল।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট রয়েছে। কমিশনের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা আইনি সীমানায় থাকা সত্ত্বেও এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তারা প্রবাসীদের ভোটে আনার জন্য আইনি পরিবর্তনের প্রস্তাব করছেন। বিশেষত রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী, নারী, অক্ষম এবং কর্মস্থলের কারণে ভোট দিতে না পারা ব্যক্তিদের জন্য ভোটাধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
কমিশন এর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে কর্মস্থল বা নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকা ব্যক্তিদের জন্যও পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে ভাবছে। তবে বর্তমানে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, প্রবাসী ভোটারদের জন্য ভোটিং আইডেন্টিফিকেশন ব্যবস্থা। বেশিরভাগ প্রবাসী ভোটারদের কাছে ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, যা আইনি বাধার সৃষ্টি করছে। এজন্য পাসপোর্ট ব্যবহারের সুযোগও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন আগামী দিনে আইনি সংস্কারের জন্য নীতিগত পদক্ষেপ নিতে এবং প্রবাসীদের ভোট অধিকার সুরক্ষিত করতে কাজ করছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, তারা যাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাদের সবাই প্রবাসীদের ভোটের অধিকার নিয়ে চিন্তা করছেন।
এর পাশাপাশি, ২১ নভেম্বর গঠিত নির্বাচনী কমিশনও নির্বাচন আইন সংস্কারের বিষয়ে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে আইন সংশোধন করার জন্য সরকারকেও তারা অনুরোধ করবে।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রবাসী ভোটারদের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, আইনি জটিলতা, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতা এবং ভোটারদের অনাগ্রহ প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করছে। পরবর্তী নির্বাচনে যদি ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেড় কোটি প্রবাসীসহ দেশের অভ্যন্তরের অন্যান্য বঞ্চিত জনগণের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়াবে।